শুভ জন্মদিন হে কবিগুরু
প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ
“আমার মাঝে তোমার লীলা হবে,
তাই তো আমি এসেছি এই ভবে।
এই ঘরে সব খুলে যাবে দ্বার,
ঘুচে যাবে সকল অহংকার,
আনন্দময় তোমার এ সংসার
আমার কিছু আর বাকি না রবে।”
যার জন্ম না হলে বাংলা সাহিত্য পরিপূর্ণতা পেত না, যার জন্ম না হলে বাঙালির বাঙালিয়ানার গৌরব হত না সম্পূর্ণ, তাঁর নাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ ২৫শে বৈশাখ, কবিগুরুর এই ভবে আসার দিন, শুভ জন্মদিন। ১৫৫ বছর আগের এই দিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
নোবেল বিজয়ী প্রথম এশীয় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতি এবং ব্রাহ্ম ধর্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সারদাসুন্দরী দেবীর চতুর্দশ সন্তান। বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি; গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৪৭ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তাঁর অভিলাষ কবিতাটি প্রকাশিত হয় যা ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা।
কিন্তু আমরা যদি শুধু কবি পরিচয়ে রবীন্দ্রনাথকে আবদ্ধ করে রাখতে চাই তাহলে তা হবে একটি মাত্র পাত্রে সমুদ্রের পানি ধরে রাখার মতো নির্বুদ্ধিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তিনি উজাড় করে দিয়েছেন বাংলা সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে। এক হাতে লিখে গেছেন শত-সহস্র অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত লাইন যা সমৃদ্ধ করেছে বাংলা সাহিত্যকে তুলনাহীনভাবে। পশ্চিম বাংলার লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর “”প্রথম আলো” উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের এই সব্যসাচী লেখনীর দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, স্বয়ং বিদ্যার দেবী স্বরসতী ভর না করলে এত লেখা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের মতে, বাংলা সাহিত্যের বেশিরভাগ সুন্দর কথাই রবি ঠাকুর বলে গেছেন।
গীতঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ “দ্যা সংস অফারিংস” এর জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল পুরুস্কার পান এবং বিশ্বকবি হিসেবে খ্যাত হন। তাঁর প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫২। মূলত কবি হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু একই সাথে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার। মূলত হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাগুলির চাহিদা মেটাতে তিনি তাঁর ছোটগল্পগুলি রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনকালের একটি পর্যায় ছিল “সাধনা” পর্ব যার ব্যাপ্তি ছিল ১৮৯১ সাল থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত। তাঁর তুমুল পাঠকপ্রিয়গল্পগুচ্ছ গল্পসংকলনের প্রথম তিন খণ্ডের চুরাশিটি গল্পের অর্ধেকই রচিত হয় এই সময়কালের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি বা আধুনিক ধ্যানধারণা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতেন। কখনও তিনি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বৌদ্ধিক বিশ্লেষণকেই গল্পে বেশি প্রাধান্য দিতেন।
এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩টি উপন্যাস রচনা করেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চোখের বালি, বৌঠাকুরানীর হাঁট, গোরা, ঘরে বাইরে প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের অন্য সব শাখার মতো ফুল ফুটিয়েছেন নাটক, প্রবন্ধ ও পত্র সাহিত্যেও। আর রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া তো বাঙালির অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায় না। প্রায় ২০০০ গান লিখেছিলেন কবিগুরু।
আধ্যাত্নিকতা, প্রেম, প্রকৃতি, দেশপ্রেম প্রভৃতি ছিল রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির বিষয়বস্তু।
রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষেরা খুলনা জেলার রূপসা উপজেলা পিঠাভোগ গ্রামে বাস করতেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনের দীর্ঘ একটি সময়ও কেটেছে এই পূর্ব বাংলায়, কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পদ্মার পাড়ে।
অবশ্য ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯০২ সালে তাঁর স্ত্রী মৃনালিনী দেবী মাত্র ৩০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গ-ভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানোয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন।
জীবনের শেষ চার বছর কবিগুরু ধারাবাহিকভাবে অসুস্থ থাকেন। কিন্তু এর পরও মৃত্যুর সাত দিন আগ পর্যন্ত তিনি সৃষ্টিশীল ছিলেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রত্ন, উজ্জ্বলতম নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি বাংলা ও বাঙালিকে দিয়ে গেছেন গর্ব করার মতো অজস্র উপহার।
বিশ্বকবির ১৫৫তম জন্মবার্ষিকীর এই শুভলগ্নে কবির প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া